https://somoyjournal.com/newspost/42808/%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%87-%E0%A6%AE%E0%A7%81%E0%A6%96%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%AF%E0%A6%BC-,-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%A8-%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0
জামাল উদ্দীন:
সম্প্রতি এআই প্রযুক্তি নিয়ে চীন ও মার্কিনিদের প্রতিযোগিতা দেখে অনেকেই ভাবতে পারেন- আমরা কোথায় আছি? আমাদের এখানকার এই মুহূর্তের আলোচ্য বিষয় কি? অর্থনৈতিকভাবে আমাদের অগ্রগতি কিংবা সূচকগুলোর নিম্ন গতিতেও কি আমাদের ভাবনা আছে? নাকি সাধারণ জনগণের মৌলিক চাহিদা নিয়েও নূন্যতম উদ্বেগ কাজ করছে? -কোনটাই নয়, বরং কম গুরুত্বপূর্ণ ও কেবলই পেছনে হটার বিষয়গুলি আমাদের সমাজে মূখ্য আলোচ্য। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে? আসলে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো যখন অপূর্ণ রয়ে যায়, তখন এগুলো বাস্তবায়নের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্যদিকে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিতে আমরা বেশ সিদ্ধহস্ত। বলা হয়ে থাকে, একটি দেশের স্বাধীনতা তখনই পূর্ণতা পায় যখন সে দেশের জনগণ সাংবিধানিক মৌলিক অধিকারগুলো ভোগ করতে পারেন। সেজন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই জরুরী। রাজনীতিবিদগন রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্র পরিচালনায় কোন ব্যর্থতা থাকলে তার বিরূপ প্রভাব পড়ে দেশে জনগণের উপর। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পর বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছে। '৭০ দশকেও যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে ছিল সেগুলো এখন বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। বাংলাদেশ যে অগ্রসর হয়নি তা নয়, কিন্তু প্রত্যাশিত মাত্রায় অগ্রসর হতে পারেনি। যে পরিমাণ সময় ব্যয় হয়েছে সে তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি নগণ্য। যদিও বিভিন্ন সময় বিশ্ব ব্যাংক আই এম এফ কিংবা অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীরা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মিরাকল বলেই চালিয়েছেন। কিন্তু এই মিরাকেলের নেপথ্যে ছিল আনঅর্গানাইজড সেক্টর। সে বিষয়ে আরেক দিন আলোকপাত করবো।
বাস্তবতা হচ্ছে ধাপে ধাপে এগিয়ে গেলেও বারবার হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। এর একটাই কারণ রাজনীতি। রাজনৈতিক সংস্কার কিংবা রাজনৈতিক সমাধান যাই বলি না কেন, সেটি নিশ্চিত না হওয়ায় বাংলাদেশ বারবার পিছিয়ে পড়ছে। গণতন্ত্র হোছট খাওয়া মানে অর্থনীতির গতি স্লথ হয়ে যাওয়া। যেটা আমরা ওয়ান ইলেভেনের সময় ও দেখেছি। বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বেশ কিছু খাতে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছে। বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠিত হয়েছে। কোন কোন কমিশন তাদের রিপোর্টে প্রকাশ করেছে। কিন্তু এর ফলপ্রসূ বাস্তবায়ন কোন দিকে সেটি এখনো প্রশ্ন সাপেক্ষ।
এ দেশের সাধারণ জনগণ দুবেলা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারলেই সন্তুষ্ট। সেই জনগণের জীবন জীবিকার খোঁজ সরকারিভাবে কতটা নেয়া হচ্ছে বা আদতে সাধারনের কথা বিবেচনায় আছে কিনা সেটিও পরিষ্কার নয়। সাম্প্রতিক বিভিন্ন খাতে ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বৃদ্ধির বিষয়টি সাধারণের মাঝে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারণ ভ্যাটের হার বাড়ানোর ফলে সাধারণ জনগণকে বাড়তি দামে পণ্য কিনতে হবে। ভ্যাট জনগণই দিচ্ছে, কিন্তু মাস শেষে তার পকেট থেকে যে বাড়তি টাকা চলে যাচ্ছে সেটা পোষাবে কিভাবে? তার আয় কি একই হারে বাড়ছে?
ভ্যাট নিয়ে আরো কিছু সংশয়ও রয়েছে। ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর মূলত সেবা বা পণ্যের উপরে যে পরিমাণ মূল্য সংযোজিত হয়েছে তার ওপর নির্ধারিত হারে ভ্যাট গণনা হবে। ভ্যাটের সেই মূলনীতি থেকে সরে এসে এখন ঢালাও ভ্যাট আরোপ এবং আদায়ের কৌশল নেয়া হচ্ছে। অতীতের সরকারগুলো তাই করেছে। ভ্যাট থেকে সরকারের রাজস্ব আদায় করা খুব সহজ। তাই এখাতে সবাই বেশি জোর দিয়ে থাকে। বর্তমান সরকারের প্রতি সাধারণ জনগণের প্রত্যাশা ছিল ভিন্ন। যেমন চেয়েছিল এ সরকার তাদের জীবনযাত্রাকে কিছুটা সহনীয় ও সহজ করতে ভূমিকা রাখবে। কিন্তু বছরের শুরুতেই ঢালাও ভ্যাট আরোপ জনগণের মাঝে হতাশা বাড়িয়েছে। যদিও কোন কোন খাতে ব্যাটের হার পুনঃপর্যালোচনা করা হয়েছে। অনেকেই এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছেন। সামনে বাজেট। বাজেট মানে আরেক দফা ভ্যাট ট্যাক্স বাড়বে, এমনটাই সবার ধারণা। তার কয়েক মাস আগেই এভাবে ভ্যাটের হার বাড়িয়ে দেয়াটাকে অযৌক্তিক বলেই মনে করেছেন বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তাগন ।
অনেকেই বলে থাকেন বাংলাদেশর অধিকাংশ মানুষ ভ্যাট-ট্যাক্স দেয় না। যদিও প্রত্যক্ষ করের বিষয়টি এখানে অনেকেই বুঝিয়ে থাকেন। কিন্তু পরোক্ষ করের মাধ্যমে প্রতিটি জনগণই সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে থাকেন। শুধু ফকির কি ধনী বলতে ট্যাক্স এর কাছে সবাই সমান। বিশেষত ভ্যাটের আওতা বাড়ানোর ফলে প্রতিটি সেবা কিংবা পণ্য কেনার সময় ক্রেতারা ভ্যাট দিয়ে থাকেন। শুধু ভ্যাটই নয়, ক্ষেত্রভেদে সম্পূরক শুল্ক, আবগারি শুল্ক পরিশোধ করতে হয়। সুতরাং সাধারণ জনগণ বা প্রতি জন ক্রেতা মানেই একজন করদাতা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের বাইরে মূল্যস্ফীতিও বিদ্যমান। মূল্যস্ফীতিও এক ধরনের ট্যাক্স। কাজেই প্রতিটি জনগণের কাছ থেকে ট্যাক্স আদায়ের ব্যাপারে যতটা গভীর মনোযোগ, ঠিক ততটাই উদাসীন নাগরিকের মৌলিক সেবা বা চাহিদা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে। এখানে রাষ্ট্রের দায় জনগণের কাছে ঠিক কতটা তা নিয়েও নানাজানের নানা মত। আমলারাও দায়িত্বে থাকলে তাদের ভূমিকা একরকম। দায়িত্ব থেকে সরে গেলে তাদের চিন্তা ভাবনা কিংবা কথার সুর পাল্টে যায়।
একথাও ঠিক যে রাষ্ট্রীয় পলিসি কিছু ক্ষেত্রে বাহ্যিক প্রভাবেও প্রভাবিত হয়। সেটা দরিদ্র দেশগুলোর সবার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও বাহ্যিক চাহিদার মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং সাধারণ জনমনে স্বস্তি দেয়ার নীতি গ্রহণই একটি ভারসাম্যমূলক পরিস্থিতি নিশ্চিত করতে পারে।
যদিও আমরা জানি যে দেশের অর্থনীতি চরম ক্রান্তি কাল অতিক্রম করছে। ব্যাংকিং খাতে লুটপাট, যেনতেনভাবে উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা সরবরাহকারী ঋণের ফাঁদে আছে দেশ। এই ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য সহায়ক অর্থনৈতিক সামর্থ্য সরকারের সামনে নেই। বিগত সময়ে বাংলাদেশের যে হারে বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে তা পরিশোধ করা এখন চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ এখন প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের ঋণের জালে আটকা রয়েছে। যেসব কারণে কিংবা যে প্রকল্পে এ ধরনের ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল সেসব প্রকল্পের বাস্তবায়নও মান সম্মত হয়নি। কোন কোন প্রকল্প রয়েছে যেগুলো বাস্তবায়নের পর তা থেকে প্রাপ্ত অর্থ খুবই নগণ্য, যা দিয়ে ঋণ শোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। সরবরাহ ঋণের নেতিবাচক প্রভাব থাকলেও বিগত সময়ে এই ঋণ নেয়ার প্রতি বেশি আগ্রহী ছিল সরকার। সাপ্লায়ারস ক্রেডিট বা সরবরাহকারী ঋণ প্রকল্পের যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম সবকিছুই ঋণ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বেশি দামে ধরা হয়। এই ঋণের সুদের হার বেশি এবং স্বল্প সময় পরিশোধ করার শর্ত থাকে। অথচ উন্নয়ন সহযোগী তথা বিশ্ব ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিলে তার সুদের হার কম থাকে এবং দীর্ঘমেয়াদী পরিশোধ করতে হয়।
এখন ঋণ পরিশোধ ও দৈনন্দিন ব্যয় মিটানোর কাজে সরকার সংকটে রয়েছে। সরকারের আয় বাড়ানোর জন্যই বিভিন্ন খাতে রাজস্ব আদায়ের নজর দিয়েছে। কিন্তু দেশের ব্যবসা বাণিজ্য গতিশীল না হলে রাজস্ব আয় বাড়বে না এটাই স্বাভাবিক। ব্যবসায়ী মহলের প্রত্যাশা ছিল সরকার বরং ব্যবসা বান্ধব নীতি গ্রহণের মাধ্যমে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেবে, যার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্য গতিশীল হবে এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণ হলে সরকারও রাজস্ব পাবে।
তবে এই মুহূর্তে অর্থনৈতিক সূচক গুলোর প্রায় সবগুলোই নিম্নমুখী বিষয়টি সম্ভবত নীতি নির্ধারকগণ বুঝতে পেরেছেন। হয়তো সে কারণেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান বলেছেন যে আগামী বাজেটে ট্যাক্স বাড়াবেন না। শুধু ট্যাক্স বাড়ানোর বিষয় নয় দরকার দেশের শিল্প এবং বাণিজ্যিক আমদানিকারকদের মধ্যে শুল্কহারের সামঞ্জস্যিকরন। কারণ, শিল্পে প্রাধান্য দিয়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ব্যবস্থাকে সক্রিয় করতে পারলে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করার সহজ হবে। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয় সাশ্রয় হবে। আমদানির মাধ্যমে মুদ্রা পাচারের ঘটনাও কমবে। দিনশেষে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে হবে। যা অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য বড় নিয়ামক হিসাবে কাজ করবে। রাজনীতিবিদদের উচিত প্রথাগত রাজনৈতিক আচরণ থেকে বেরিয়ে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মনোযোগী হওয়া। কারণ, সারা বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে। শুরুতেই বলেছি, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এআই প্রযুক্তি নিয়ে যে পরিমাণ প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করেছি তা থেকে আমাদের শিখতে হবে। আমরা যে কতটা পিছিয়ে আছি সেটা অনুধাবন করতে হবে। সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাওয়ার এখনই সময়।
-লেখক : সাংবাদিক।
Post a Comment