গুডবাই নয়, ওয়েলকাম
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্রের যাত্রা শুরুর পর থেকে এই সময় এসেও আমরা কি উপলব্ধি করতে পেরেছি আমাদের ভুলগুলো কোথায়। কিংবা বিশ্বের সঙ্গে এগিয়ে যেতে হলে আমরা কি আমাদের প্রায়োরিটিগুলো ঠিক করতে পেরেছি? বরং হানাহানির রাজনীতিই আমরা বেশি করছি। চালু রাখছি। যার ফলে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের উন্নয়ন। অগ্রযাত্রা হোঁচট খাচ্ছে বারবার। শংকা আর উদ্বেগ বাড়ছে বর্তমান ও ভবিষ্যত্ নিয়ে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য কিংবা বিনিয়োগ হবে কিভাবে? বিনিয়োগ করতে হলে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সহায়ক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। এই সহায়ক পরিবেশের মধ্যে রাজনৈতিক সংঘাতমুক্ত পরিবেশ, নীতি প্রণয়নও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। অস্থিতিশীল রাজনীতি যদি সংঘাত ডেকে আনে, তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়বে এমনটাই স্বাভাবিক। নতুন বিনিয়োগ আসবে না। এমনকি নতুন ক্রেতারাও আসবে না। দেশে যদি সুষ্ঠু ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ না থাকে তাহলে বিদেশি ক্রেতারা কিভাবে আসবে? তাদের জানমালের নিরাপত্তা দেবে কে?
এই নিরাপত্তার বিষয়টি ব্যবসা-বাণিজ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নিরাপত্তা ইস্যুটিই এখন বাংলাদেশের জন্য বড় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা আর নিজেদের নিরাপদ ভাবছেন না। শুধু জানের মায়ায় নয়, তাদের বিনিয়োগকৃত অর্থের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। সে কারণেই আমরা তাদের মুখে 'স্যরি' শব্দটি শুনছি।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সম্ভাব্য ক্রেতা, প্রতিনিধিদল নিয়ে এসেছিল বাংলাদেশে। গত ২৭ মার্চ বুধবারের হরতালের দিন। বিমানবন্দরে নেমেছেনও। কিন্তু বাইরে বের হতে পারেননি। হরতাল, ধর্মঘট থাকলে কিভাবে বের হবেন? তারা তো এ ধরনের পরিস্থিতিতে অভ্যস্ত নয়। জীবনের মায়া তাদের আছে। তাই তারা ফিরে গেলেন রাশিয়ায়। কিন্তু স্থানীয় বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরাতো হতাশ। তারা ক্রেতার খোঁজ-খবর না পেয়ে অস্থির হয়ে উঠলেন। পরে একটি ইমেইল বার্তায় জানানো হয় যে, তারা ফিরে গেছেন রাশিয়ায়। খবরটি দৈনিক ইত্তেফাকেই প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। এর মানে বিদেশি ক্রেতারা বাংলাদেশ বিমুখ হচ্ছেন। বাংলাদেশি পণ্যের প্রতি তাদের আগ্রহ আছে। কিন্তু বিদ্যমান অস্থিতিশীল পরিবেশ তাদের নিরাপত্তাহীনতার দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছে। এখানে কেন তারা আসবেন? প্রতিযোগী আরো দেশ রয়েছে। সেসব দেশে বাংলাদেশের মত রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। কাজেই ওসব দেশেই বিদেশি ক্রেতারা যাবেন এমনটিই স্বাভাবিক।
একই কথা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। সাম্প্রতিক সময় বিনিয়োগ বাস্তবায়ন প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে গেছে। স্থানীয় বিনিয়োগেও দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। রাজনৈতিক অস্থিরতার তীব্রতায় অসংখ্য বিদেশি বিনিয়োগকারী বাংলাদেশে বিনিয়োগের চিন্তা করেও তা বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। একথা সবাই মানবেন যে, এমন এক বৈরী পরিবেশে বিনিয়োগ করবেন কে? উপরন্তু সামনের দিনগুলো আরো বেশি অনিশ্চয়তার। দিনের পর দিন হরতাল যদি হয়, ভাঙচুর, জ্বালাও-পোড়াও হলে বিনিয়োগ তো দূরের কথা, স্বস্তিতে দিন কাটানোও সম্ভব হয় না। উদ্বেগের মধ্যে বরং ব্যবসায়ী-শিল্পোদ্যোক্তারা। ইতিমধ্যে যে অস্থিরতা দেশকে গ্রাস করেছে তার ফলে কি ধরনের ক্ষতি হয়েছে তার সামান্য বিরবণ আমরা উল্লেখ করতে পারি। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প মালিক সমিতি বলেছে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার (৫০ কোটি ডলার) রফতানি আদেশ হারিয়েছে তৈরি পোশাক খাত। এসব অর্ডারের বেশিরভাগ প্রতিবেশী দেশ ভারতসহ ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় চলে গেছে। পোশাক শিল্পের বড় ক্রেতারা প্রতিবছর অর্ডার নেগোসিয়েশন ও অর্ডার দেয়ার জন্য তাদের প্রতিনিধি এদেশে পাঠালেও এবারের গ্রীষ্ম মওসুমকে সামনে রেখে অর্ডার দেয়ার জন্য এ মুহূর্তে তারা প্রতিনিধি পাঠাতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। বরং 'নিরাপত্তাজনিত' কারণ দেখিয়ে অর্ডার নেয়ার জন্য বাংলাদেশি পোশাক সরবরাহকারীদের তাদের হেডকোয়ার্টারে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অনেকেই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করে আকাশপথে পণ্য পাঠিয়েছেন। তাতে মূল্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতাও কমে যাচ্ছে। আবার অনেক উদ্যোক্তা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জাহাজীকরণ করতে না পারার কারণে অর্ডার বাতিল হয়ে গেছে।
এতসব ক্ষতি কিভাবে পুষিয়ে নেবে এই গরীব দেশ। গার্মেন্টস রফতানির প্রসঙ্গ এলে আরো কিছু তথ্য আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এই পণ্যটি এককভাবে প্রধান রফতানি পণ্য। এ শিল্পের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে আছে ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবন-জীবিকা। এ শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ ইন্ডাস্ট্রি। রয়েছে ব্যাংক-বীমা, শিপিং, পর্যটন, হোটেল, পরিবহনসহ বিভিন্ন ধরনের সেবা। এসব খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থানও হয়েছে। কিন্তু ঘনঘন হরতার আর রাজনৈতিক অস্থিরতায় যদি পোশাকখাত ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে সংশ্লিষ্ট সহায়ক শিল্পগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাতে কর্মহীন হবে বহু লোক। ক্ষতিগ্রস্ত হবে অর্থনীতির। সে বিষয়টি অনুধাবনযোগ্য।
বিদ্যমান পরিস্থিতি শুধু যে রফতানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে তা নয়, বরং এর একটি 'চেইন ইফেক্ট' গোটা অর্থনীতিকে ভঙ্গুর করে তুলছে। গ্যাস, বিদ্যুত্ সংকটের কারণে বিগত কয়েক বছর ধরেই শিল্পের ত্রাহি দশা বিরাজ করছিল। জ্বালানি সংকটে কারখানাগুলো নিজস্ব ক্ষমতা অনুযায়ী উত্পাদন করতে পারেনি। ফলে ঋণগ্রস্ত কারখানাগুলো আরো বেশি সমস্যায় পড়ে যায়। ব্যাংকের কিস্তি দিতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তাদের। সেই সমস্যার ধারাবাহিকতা এখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে রাজনৈতিক সংকট। একের পর এক সংকটের মধ্যে চলতে থাকা শিল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে সহায়ক নীতিও গ্রহণ করা হয়নি। বিশেষত খেলাপি ঋণ সংক্রান্ত নীতিমালা নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। এই বিতর্কের সঠিকতা পাওয়া যায়, যখনি আমরা দেখি গত এক বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে।
সব মিলিয়ে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংঘাত পরিস্থিতিকে আরো বেশি জটিল করে তুলেছে। ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া কিংবা শিল্প রুগ্ন হলে ব্যাংকের টাকা যেমন ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে, তেমনি কর্মহীন হয়ে পড়ার উপলক্ষ তৈরি হয়েছে লাখ লাখ লোকের। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে আগামী দিনগুলো ক্রমেই সম্ভাবনাহীন হয়ে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর তাতে সংকটের মাত্রা আরো বাড়বে। তাই সংঘাতের রাজনীতি বন্ধ হওয়া খুবই জরুরি। দেশের স্বার্থে অর্থনীতিকে ত্বরান্বিত করতে হবে। অর্থনীতি নিয়ে রাজনীতিবিদদের ভাবতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে বিনিয়োগকারী ও বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা। কেউ যাতে 'স্যরি' বলে বিমানবন্দর থেকে ফিরে না যায়। বিনিয়োগকারীরা যাতে বাংলাদেশকে গুডবাই না জানায়। আমরা 'গুডবাই' জানাতে চাই বিদ্যমান সংকটকে। আমাদের পণ্যের ক্রেতা কিংবা বিনিয়োগকারীদের জানাতে চাই 'স্বাগত'। গুডবাই নয়, ওয়েলকাম। অর্থনীতির জন্য সেই শুভলগ্ন আনতে উদ্যোগ নেয়াই হোক এই মুহূর্তের প্রধান করণীয়। (প্রকাশ :ইত্তেফাক, ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ০৪ এপ্রিল ২০১৩, ২১ চৈত্র ১৪১৯)
লেখক : কথাশিল্পী ও সাংবাদিক