জামাল উদ্দীন||
অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বিশ্বের ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রে বেকারত্বের হার বেড়ে যায়। মন্দাক্রান্ত বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতই মার্কিন নাগরিকদের একটি অংশ কাজ পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে। যে কারণে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কর্মসংস্থানের ইস্যুটি বড় হয়ে দেখা দেয়। প্রার্থীরাও বেকারত্ব নিরসন ও কাজের সুযোগ সৃষ্টির বিষয়টিকে বেশ গুরুত্ব দেয়। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জন্য মন্দাক্রান্ত অর্থনীতিতে কাজের সুযোগ সৃষ্টিই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। আর্থিক নীতির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে নতুন কর্মসংস্থান যোগাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন এমনটি বলা যায়। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ফেব্রæয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রে ২ লাখ ৩৬ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়। জানুয়ারিতে যেখানে বেকারত্বের হার ছিল ৭ দশমিক ৯ শতাংশ। সেখানে ফেব্রæয়ারিতে বেকারত্বের হার কমে ৭ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়ায়। অর্থাৎ বেকারত্ব কমেছে দশমিক ২ শতাংশ।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরের পর বেকারত্বের এই হার সবচেয়ে কম। জানুয়ারি মাসে ১ লাখ ৫৭ হাজার নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে এক মাসের ব্যবধানে ২ লাখ ৩৬ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি বেশ ইতিবাচক। বিবিসির খবর অনুযায়ী, গত মাসে পেশাগত ও ব্যবসা খাতে যোগ হয়েছে ৭৩ হাজার কর্মসংস্থান। নির্মাণ শিল্পে নিয়োগ পেয়েছেন ৪৮ হাজার কর্মচারী। ¯^াস্থ্য খাতে সংযোজিত হয়েছে ৩২ হাজার ও খুচরা বিক্রি খাতে ২৪ হাজার নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে ঘরে বসেই আমরা সুদুর আমেরিকার কর্মসংস্থানের তথ্য জানতে পারছি। কিন্তুু আমাদের দেশে মাসে কি পরিমান কর্মসংস্থান হচ্ছে, তা কি জানতে পারছি? মাসে নয়, বছরে এমনকি একটি সরকারের মেয়াদকালে কি পরিমান কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়, সে তথ্যও সঠিকভাবে আমরা পাই না। এমনকি বিষয়টি আমাদের জাতীয় গুরুত্ব থেকেও যেন পিছিয়ে। বিভিন্ন দেশের বাজেট ঘোষণার সময় কর্মসংস্থানের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দীর্ঘদিনই এ বিষয়টি উপেক্ষিত ছিল। স¤প্রতি বাজেট বক্তৃতায় কর্মসৃজনে কিছু প্রকল্পের কথা বলা হয় মাত্র। কিন্তুু প্রকৃত অর্থে কি পরিমান কর্মসংস্থান হবে, কিংবা আগের বছর হয়েছে তা উঠে আসে না। অথচ আমাদের রাজনীতিকেরা ভাত-কাপড়ের কথা বলে মুখে খই ফোটান। কিন্তু বাইরের দেশের অবস্থা কি? সেসব দেশে বেকারত্ব নিরসনের বিষয়টি উঠে আসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডা হিসাবে। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের বিষয়টি পুনর্বার উল্লেখ করতে চাই।
আমরা যদি মার্কিন নির্বাচনে বারাক ওবামা কিংবা মিট রমনির বক্তৃতাগুলো ফিরে দেখি তাহলে দেখবো কতবার তারা কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন। অর্থনীতিই এই নির্বাচনে মূখ্য ছিল। কেবল কাজ আর কাজের কথাই উঠে এসেছে দুই প্রার্থীর মুখে। সম্ভবত এ কারণেই যে, মানুষকে কাজের সুযোগ দিয়ে আয়ের পথ সুগম করে দিতে হবে। বেকারত্ব লাঘব করলে ওসব শ্রমঘন্টা অর্থনীতিকে উন্নত প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। বিশ্বমন্দার পর মার্কিন অর্থনীতিতে যেভাবে ধস নেমেছিল, তাতে প্রথমবার নির্বাচিত হয়ে কাজ চালিয়ে যাওয়া ছিল বারাক ওবামার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু শেষদিকে এসে অর্থনীতি কিছুটা গতি পায়। নির্বাচনের ঠিক আগে, ২০১২ সালের অক্টোবর মাসেই ১ লাখ ৭১ হাজার কর্মসংস্থান নিশ্চিত হয় যুক্তরাষ্ট্রে। যা বেকারত্বের সূচককে যেমন নিম্নমুখী করেছিল, তেমনি ওবামার জন্যও আশির্বাদ হিসাবে কাজ করে। নির্বাচনের আগে এমন একটি খবরকে পুঁজি করে ভোট প্রার্থনা করতে পেরেছেন ওবামা।
বিশ্বের এই ধনী দেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশেও উৎসাহ-উদ্দীপনার কমতি ছিল না। রিপাবলিকান আর ডেমোক্রেট নিয়ে যত মাতামাতি। মার্কিন মুলুকের মত আমাদের দেশেও মূলত দুটি দল (বলছি প্রধান দুটি দলেরই সিংহভাগ জনসমর্থনের কথা) রয়েছে। সে কারণেই হয়তো আওয়ামী লীগ-বিএনপি বলতে বলতেই রিপাবলিকান না ডেমোক্রেট এই আলোচনার ব্যাপ্তি ঘটেছে। সেই সঙ্গে মার্কিন নির্বাচনী হাওয়া আমাদের দেশের নির্বাচন নিয়ে জনগণের মধ্যে নানান ভাবনার খোরাক যুগিয়েছিল। নির্বাচন হবে কি না, কিংবা তত্বাবধায়ক সরকার না দিলে বিরোধীদল নির্বাচনে অংশ নেবে কি না। বিরোধীদলীয় নেত্রীর ভারত সফর, রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণের আভাস দিয়েছিল। ¶ুদ্র দলগুলোর একতাবদ্ধ হয়ে জোটগঠনের উদ্যোগও মনে করিয়ে দিচ্ছিল নির্বাচনের সময় এসে গেছে।
গনতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থায় নির্বাচন হবে এমনটিই ¯^াভাবিক। অতীতেও হয়েছে। কখনো ¯^াভাবিকভাবে, কখনো বা সংঘাতের পর সরকারী পক্ষ নির্বচানের দাবি মেনেছে। রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামের আর দেখার কিছু বাকি নেই সাধারণ মানুষের। অতীতে দেখেছে, এখনো দেখছে। একই ট্র্যাডিশন কতদিন আর ভাল্লাগে। তাই মানুষ চায় রক্তপাতহীন সরকার বদল। কিন্তুু চাইলেই কি হবে? উত্তর হতে পারে- হবে না কেন? জনগনইতো সকল ক্ষমতার উৎস। তাহলে জনগণ যা চাইবে, তাইতো হওয়ার কথা। কিন্তুু বাস্তবে কি তা হয়েছে? ধরে নিই, জনগণ চায় দুবেলা খেয়েপরে বাঁচতে। তার জন্য কাজ দরকার। বছরে বিশ লাখ যুবক কর্মসংস্থান বাজারে আসছে। কিন্তুু কাজ মিলছে না। বর্তমান সরকার তার নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিল, প্রতিটি পরিবারের একজন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ দেবে। সে লক্ষ্য এখনো অর্জিত হয়নি। বড় বিষয় হলো দেশে কি পরিমাণ লোক বেকার কিংবা কত কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে সে পরিসংখ্যানইতো সঠিকভাবে সরকারের কাছে নেই। তবু ভাল যে, কর্মসংস্থানের বিষয়টি নির্বাচনী ইশতেহারে যোগ হয়েছে। তবে প্রকৃত উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছে সঠিক তথ্য থাকা চাই। তবেই না সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হবে। কারণ বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রয়োজনীয় লক্ষ্য স্থির করেই কেবল কাক্সি¶ত উন্নয়ন করা সম্ভব। অথচ কর্মসংস্থানের মতো আরও অনেক তথ্য পেতেই নীতি নির্ধারকদেরকে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে বিনিয়োগের তথ্য, আয়-ব্যয়ের তথ্য, প্রকৃত জনসংখ্যা এবং দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। এ তথ্যগুলো ¯^ল্প সময়ের ব্যবধানে পাওয়া গেলে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা না থাকায় সরকার দেশের জনসংখ্যার আকার এক রকম ভেবে সে হিসেবে খাদ্য মজুদ বা অন্য সব পরিকল্পনা গ্রহণ করে কিন্তু পরে দেখা যায় খাদ্য আমদানি হয় বেশি হয়েছে নতুবা রফতানি না করায় আবাদকৃত ফসল পানির দরে ছাড়তে হচ্ছে। আর এ ধরনের ঘটনা ঘুরে ঘুরেই ঘটছে। ফলে কৃষকরা আবাদে অনুৎসাহিত হচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রানের জন্য সরকারের কাছে সব ধরনের সঠিক তথ্য ¯^ল্প সময়ের মধ্যেই থাকতে হবে। উন্নত বিশ্বে সঠিক তথ্যের প্রয়োগ ও ফলাফল খুব ভালোভাবে দেখা যায়। কিন্তু বাংলাদেশে প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো বছর অন্তে পাওয়া যায়, তাও কতটা সঠিক তা নিয়েও প্রশ্ন থাকে। ফলে গোড়ায় গলদ থাকলে যা হওয়ার তা-ই হয়। সরকার যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে নীতি গ্রহণ করে পরবর্তীতে দেখা যায় প্রকৃত তথ্য সেটি নয়। ফলে পরিকল্পনাটিও সঠিক হয়না। আর কর্মসংস্থান নিয়ে দেখা যায়, সরকার কিংবা বিরোধী দল ঢালাওভাবে নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে যাচ্ছেন। সরকার বলেন, ভুরি ভুরি কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে, দরিদ্রতা জাদুঘরে চলে যাচ্ছে। আর বিরোধী দল বলে, দেশে বেকারত্ব বাড়ছে আর বাড়ছে। দরিদ্রতাও বাড়ছে চরমভাবে। অথচ প্রকৃত তথ্য কারো কাছেই নেই।
সরকার পরিচালনার দায়িত্ব বা ক্ষমতার পালাবদল গণতান্ত্রিক নিয়মেই হবে- এমনটিই ¯^াভাবিক। তাহলে বাংলাদেশেও যথা সময়ে নির্বাচন হবে, এমন আশা নাগরিক মাত্রই করবেন। নির্বাচন নিয়ে হানাহানি আর অর্থনীতি ধ্বংস করে এমন আত্মঘাতি কর্মসূচিও কাম্য হতে পারে না। কিন্তুু পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তা শুভ কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে না। এখানে সরকার কিংবা বিরোধীদল কেউই প্রধান আলোচ্য বিষয় হিসাবে কাজ বা কর্মসংস্থানকে ¯^ীকৃতি দেয়নি, দিচ্ছে না। উভয়দলই জানে না এখানে মাসে কত লোক কর্মহীন হয়ে পড়ছে। কিংবা কত লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বরং যেসব বিধ্বংসী কার্যকলাপ চলছে তা ব্যবসা-বাণিজ্যকে স্থবির করে দিয়ে আরো বেশি লোককে কর্মহীন করে দেয়ার উপলক্ষ তৈরি করছে। এতে কি লাভ হচ্ছে বুঝি না। তবে অর্থনীতির চাকা ¯^গতিতে না এগুলে দেশ যারাই পরিচালনা করুন না কেন, বেগ পেতে হবে। এরপরও উভয় দল কেন সমঝোতার রাজনীতি করেন না তার কারণ জানা নেই। কারণ হতে পারে একটাই, জনগণইতো সকল ক্ষমতার উৎস (!)। তাদের ক্ষমতায়নের আর কিইবা আছে। নিজেদের যোগ্যতায় তারা খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারবে। নইলে না খেয়ে মরবে। তাতে কারো কিছু যায় আসে না।
লেখক: কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক
(ইত্তেফাক, ২০ মার্চ ১৩ তারিখে প্রকাশিত)
Post a Comment